বাংলারজমিন
সেনাবাহিনীর হাত ধরে দুর্গম পাহাড়ে সম্ভাবনার মহাসড়ক
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৮০০ ফুট উপরে। যেখানে আজও কুয়াশার ঘন চাদরে হারিয়ে যায় দিনের আলো। সেখানে পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের চাকা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হচ্ছে দেশের ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কটির নাম-সীমান্ত সড়ক। এরমধ্যে গত ৩০শে জুন শেষ হয়েছে প্রথম ধাপের ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৪৮০ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। দুর্গমতা যেখানে এতকাল উন্নয়নের অন্তরায় ছিল, আজ সেখানে তৈরি হচ্ছে সম্ভাবনার এই মহাসড়ক। তিন ধাপের কাজের প্রথম ধাপ শেষ হতেই আলো পেতে শুরু করেছে পাহাড়। পুরো কাজ শেষ হলে এই সড়ক শুধু চলাচলের পথ হবে না, এটি পাহাড়ে সন্ত্রাস ও চোরাচালান রোধে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আর কৃষিপণ্যের সহজ বাজারজাতকরণ এবং নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার অব্যর্থ সুযোগ তো আছেই। জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর থেকে বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া থেকে জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। এ সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। পুরো রাস্তাটি সীমান্ত-সংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা সংযুক্ত হবে।
জানা যায়, ২০৩৬ সালের মধ্যে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়ক কাজ শেষ হওয়ার কথা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এই সড়ক ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করবে। প্রকল্প পরিচালক কর্নেল দেলোয়ার হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সম্ভাবনার এই সীমান্ত সড়ক প্রকল্প একনেকে ২০১৮ পাস হয়। আর ২০২০ সাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে। এই সড়কটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং-এর দিকে যাচ্ছে। এই কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এই সীমান্ত সড়ক আমাদের সড়ক, আমাদের দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এখানে আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সকল সদস্য নিরলসভাবে কাজ করছেন দেশের স্বার্থে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশাবাদী এ কাজটি সঠিক সময়ে সঠিক গুণগতমান বজায় রেখে সম্পন্ন হবে। এ কাজটি গুণগতমান সম্পন্নের জন্য যে সকল মেটেরিয়ালস ব্যবহৃত হয়, সেগুলো আমাদের ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের যে টেস্টিং ল্যাব আছে সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করা হয়। আর অনগ্রাউন্ডে ব্যবহারের সময় বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করি। কর্নেল দেলোয়ার বলেন, দুর্গম এই এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আমাদেরকে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায়। সাহস আর স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে আমরা প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠছি। আমরা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কনসালটেন্টের সমন্বয়ে টিম গঠন করে এ বিষয়গুলো সমাধান করি। এ ছাড়াও বুয়েট, এমআইএসটি, চুয়েটের সঙ্গেও সমন্বয় করছি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা জানান, আয়তনে ক্ষুদ্র এবং আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পর্যটন স্পটের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজম সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যে ক’টি পর্যটন স্পট রয়েছে সেগুলোতে মানুষ যেতে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে একসময়। এতে বাংলাদেশের মানুষ ভ্রমণের পিপাসা মেটাতে বিদেশমুখী হবে। এতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই চলে যাবে। তাই পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও অর্জন করতে বাংলাদেশে নতুন নতুন পর্যটন স্পট এক্সপ্লোরেশন করার বিকল্প নেই। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া দেশে এমন সম্ভাবনাময় স্থান খুবই অপ্রতুল। দুর্গমতার কারণে এই সম্ভাবনা ফিকে হয়েই রয়ে গেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক সে সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সীমান্ত সড়কের কারণে পাহাড়ে পর্যটন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গমতা ও অবকাঠামোর অভাবে পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন স্পট গড়ে ওঠেনি, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ে নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে উঠবে। খুব সহজেই দেশ ও বিদেশের পর্যটকরা সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে সেসব পর্যটন স্পট ভ্রমণ করবে। পর্যটকেরা শুধু ভ্রমণ খাতে নয়, পাহাড়ে উৎপাদিত ফল, ফসল ও পণ্য ক্রয় করবে। এতে করে একদিকে যেমন পাহাড়ের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, তেমনি অর্থনীতিতে আসবে নতুন জোয়ার। ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ১৭ ইসিবি’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেঁড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে দুর্গম এলাকার মানুষকে জিম্মি করে তারা যেভাবে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, দুর্গমতার কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করতো না, এখন সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতের ফলে মানুষের সাহস ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে সাহসী হবে। তিনি আরও বলেন, এই সড়কের ফলে রামগড়-সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুম-মংডু ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বৃদ্ধি করবে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
বান্দরবানের থানচি উপজেলার বাসিন্দা কৃষক ডায়মন্ড ম্রোং বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে নিয়ে যাওয়া যেতো না। এগুলো পচে নষ্ট হতো। বড় কোনো অসুখ হলে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালে নেয়া যেতো না। পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। এখন সড়ক হওয়ার কারণে সব কিছু সহজ হবে। সেনাবাহিনীর করে দেয়া স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনাও করছে। এখন খুব ভালো লাগছে। প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামছুল আলম বলেন, এই সড়ক হয়ে গেলে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম কমে যাবে। এতে করে স্থানীয় জনগণের জীবনে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। এই সড়কের কারণে সীমান্তে বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়বে। ফলে আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে এই সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাষ্ট্র থাকায় এই সড়কের কারণে জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতদিন কাগজে কলমে বাংলাদেশের সীমানার কথা জানতাম। আর এই সড়কের মাধ্যমে আমরা মূলত আমাদের হিস্যা বুঝে পেয়েছি। এখন এই সড়ক হয়ে গেলে আমাদের অবস্থান আরও সুসংহত হবে। আর ইতিমধ্যে বিজিবি’র ক্যাম্পগুলো ভেতর থেকে সরিয়ে সীমান্ত সড়কের কাছাকাছি স্থাপন করা হচ্ছে।