প্রথম পাতা
বিশ্বের নজরে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ ‘বি-২ বোম্বার’
সেবন্তী ভট্টাচার্য্য
২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
মার্কিন সেনাবাহিনীর বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমান শনিবার ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্র নাতানজ, ফরদো এবং ইস্ফাহানে হামলা চালিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মুকুটমণি ফরদো বিপর্যস্ত। এই বি-২ বোমারু বিমান মার্কিনি সেনাবাহিনীর সব থেকে উন্নত কৌশলগত অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অধীনে এটি ইরানের গোপন পরমাণুকেন্দ্রের মতো কঠিন লক্ষ্যবস্তুতেও নির্ভুল আঘাত হেনেছে। এই হামলা চালাতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ এবং ‘বি-২ বোম্বার’ কাজে লাগানো হয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, ইরানের ফরদো পরমাণুকেন্দ্রে ছ’টি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলা হয়েছে। জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি) নামেও পরিচিত এই বোমা। তা ফেলার জন্য বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমান ব্যবহার করেছে আমেরিকা। এটিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি শত্রুর রাডার ব্যবস্থায় সহজে ধরা না পড়ে। এর একটি বিশেষত্ব এর ‘ফ্লাইং উইং’ ডিজাইন, এর কোনো প্রচলিত ফুসেলেজ বা লেজ নেই, এবং এর পৃষ্ঠে বিশেষ ধরনের রাডার-শোষণকারী পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, যা রাডার সিগন্যালকে শোষণ করে বা অন্যদিকে প্রতিফলিত করে কিংবা বিভ্রান্ত করতে পারে। এটি প্রচলিত এবং পারমাণবিক উভয় ধরনের বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম এবং বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে পারে। জ্বালানি ছাড়াই এই বোমারু বিমানটি ৬০০০ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি দূরত্ব থেকে অর্থাৎ ১১,১১২ কি.মি.র বেশি দূরত্ব থেকে হামলা চালাতে পারে। বি-২ বোমারু বিমানে মাত্র ২ জন পাইলট বসতে পারেন। ফলে কম পরিচালন ব্যবস্থাতেও এর দক্ষতা ও নির্ভুলতা অনেক বেশি।
বি-২ বোম্বারের নকশা ও উন্নয়নের কাজ শুরু হয় কার্টার প্রশাসনের অধীনে ‘অ্যাডভান্সড টেকনোলজি বোম্বার (ATB)’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে। রেগান প্রশাসনের অধীনেও এর নকশার কাজ চলতে থাকে। মার্কিন কংগ্রেস এবং পেন্টাগনে এই প্রকল্পের উচ্চ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বি-২ স্পিরিট প্রাথমিকভাবে ডিজাইন করেছে নর্থরপ করপোরেশন, যা পরবর্তীতে নর্থরপ গ্রুম্যান হয়ে যায়। বোয়িং, হিউজেস এবং ভট-এর মতো কোম্পানিগুলো এটি নির্মাণে কাজ করেছে। ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এর উৎপাদন চলে এবং ১৯৯৭ সালে এটি মার্কিন বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়। মোট ২১টি বি-২ বোম্বার নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে ২০টি বর্তমানে সচল আছে।
এর ব্যয় ছিল আকাশচুম্বী। বি-২ স্পিরিট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক বিমানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি বি-২ বোম্বার নির্মাণ খরচ ২.১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অত্যন্ত বেশি, কারণ এর স্টেলথ প্রলেপ এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক সিস্টেমের নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। মূলত স্নায়ুযুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে এর উৎপাদন পরিকল্পনা ছেঁটে ফেলা হয়। প্রাথমিকভাবে ১৩২টি বিমান তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত মাত্র ২১টি তৈরি করা হয়। বি-২ বোমারু বিমানের দৈর্ঘ্য ৬৯ ফুট, উচ্চতা ১৭ ফুট এবং এর ডানার বিস্তার ১৭২ ফুট। ওজনের দিক থেকে এটি ৭১ হাজার ৭০০ কেজি, তবে বিভিন্ন ধরনের মিসাইল ও বোমা বহন করে এটি সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭০ হাজার কেজি পর্যন্ত ওজনসহ উড়তে পারে। জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্যে এটি স্থির লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত হামলার পাশাপাশি একাধিক লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম। তবে বি-২ বোমারুর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অস্ত্র হলো এর বাঙ্কার বাস্টার বা জিবিইউ-৫৭ বোমা। এর ওজন প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কেজি। বিশাল এই বোমাটি মাটির প্রায় ৬১ মিটার গভীরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতেও নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। এই বোমাটি শক্তিশালী এবং অতি-সহনশীল ইস্পাতের আবরণে মোড়া। ফলে পাথর বা কংক্রিটের তৈরি ভূগর্ভস্থ কোনো পরিকাঠামোকে অনায়াসে ধ্বংস করতে পারে। ২৪০০ কেজি বিস্ফোরকে ঠাসা পেলোড বহন করতে সক্ষম এই বোমা। সামরিক অভিযানের জন্য একবারে একটি বা দু’টি এই বোমা বহন করতে পারে বি-২ বোম্বার। পেন্টাগন নিশ্চিত করেছে যে, ইরানে চালানো হামলায় বি-২ বোমারু বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। টানা প্রায় ৩৭ ঘণ্টা উড়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করেছে বিমানটি।
তবে ইরান দাবি করেছে, তারা আগেই পারমাণবিক স্থাপনাগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলেছিল।